
নিজস্ব প্রতিবেদক | শনিবার, ০৮ মার্চ ২০২৫ | প্রিন্ট | 170 বার পঠিত
বেসরকারি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করে; ট্রিটি অনুযায়ী প্রিমিয়াম গ্রহণের কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। কোম্পানিগুলোর আড়াই হাজার কোটি টাকার বীমা দাবি ঝুলিয়ে রেখে; উল্টো পুনঃবীমা ট্রিটি নবায়নের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম পরিশোধের শর্ত দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
সূত্র জানায়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ০৮ মার্চ পর্যন্ত অন্তত ৩০ টি নন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেও সিটি ইন্স্যুরেন্স, পূরবী ইন্স্যুরেন্স, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স ছাড়া সিংহভাগ কোম্পানির রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি নবায়ন করেনি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে বলা হলেও তাদের দেনা-পাওনার হিসাব নিষ্পত্তি বা সমন্বয় না করেই শুধুমাত্র সাধারণ বীমার পাওনার জন্য ট্রিটি আটকে দেয়া হচ্ছে।
অথচ গত ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ এবং ৪৫ টি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে পুনঃবীমা নিয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন আয়োজিত মতবিনিময় সভার সিদ্ধান্ত ছিল ভিন্ন। ওই সভায় বিস্তারিত আলোচনা শেষে তিনটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বলে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। এরমধ্যে অন্যতম একটি সিদ্ধান্ত ছিল, ‘প্রত্যেক বেসরকারি বীমা কোম্পানি পুনঃবীমা ট্রিটি মোতাবেক যথাসময়ে প্রিমিয়াম প্রদান করবে এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে সচেষ্ট থাকবে।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর অর্থ কোম্পানিগুলো পুনঃবীমা ট্রিটি মোতাবেক যথাসময়ে প্রিমিয়াম দেবে; তবে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করতে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু দাবি নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা না রেখেই, এখন যথা সময়ে পুনঃবীমা প্রিমিয়াম চাচ্ছে সাধারণ বীমা।
ওই সভার তৃতীয় সিদ্ধান্তটি ছিল, ‘পারস্পারিক ব্যবসায়িক স্বার্থে ভবিষ্যতে এ ধরনের সভা আয়োজন অব্যাহত থাকবে।’ তবে রিইন্স্যুরেন্স ট্রিটি ছাড়া এ পর্যন্ত বীমা দাবি নিষ্পত্তির বিষয়ে আর কোনো সভাও ডাকেনি কর্পোরেশন। সভায় সাধারণ বীমার চেয়ারম্যান বলেন, “দাবি নিষ্পত্তিতে আমরা অত্যন্ত আন্তরিক, প্রয়োজনে কর্পোরেশনের পরিচালনা পর্ষদের সাথে আলোচনা করে দাবি প্রক্রিয়াকরণ আরও সহজ ও দ্রুততর করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দাবি নিষ্পত্তির জন্য প্রস্তাবিত চেকলিস্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পুনরায় আলোচনা করা যেতে পারে।”
তবে এখনো নানা অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়ে দাবি নিষ্পত্তিকে জটিল করে রাখা হয়েছে এমনকি দাবি প্রত্যাখান করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন যে সকল কাগজপত্রের চাহিদা প্রদান করে যার সাথে বীমা দাবি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ বিদেশি পুনঃবীমাকারীরা, যাদের সাথে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনও পুনঃবীমা করে থাকে, তারা শুধুমাত্র সার্ভে রিপোর্ট ও লস ইন্টিমেটেডের ভিত্তিতে পুনঃবীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করে থাকে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর পাঠানো অনিরীক্ষিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে পুনঃবীমা দাবি বাবদ কোম্পানিগুলোর পাওনা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। বিপরীতে পুনঃবীমা প্রিমিয়াম বাবদ কোম্পানিগুলোর কাছে কর্পোরেশনের পাওনা রয়েছে এক হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা। এসব পাওনা সমন্বয় করা হলেও সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কাছে কোম্পানিগুলোর পাওনা দাঁড়ায় অন্তত হাজার কোটি টাকা। যদিও বছরটিতে কোম্পানিগুলোর এই পুনঃবীমা দাবির পরিমাণ মাত্র ৫৭৪ কোটি টাকা বলে দাবি করেছে কর্পোরেশন।
সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের কার্যবিরণীতে দেখা যায়, গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ওই সভায় ‘সরকারি খাতের বীমা দায়গ্রহণ ও পুনঃবীমা অবলিখন ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরকারি খাতের বীমা ব্যবসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য করণীয় সম্পর্কে উপস্থিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিদের মতামত ব্যক্ত করার আহ্বান জানান। এ প্রেক্ষিতে বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি ও বিআইএ’র প্রতিনিধিবৃন্দ আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।’
কার্য বিবরণী অনুযায়ী, “পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি ও প্রয়োজনীয় দলিলাদির চেকলিস্ট পুনর্বিবেচনা বিষয়ে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’র সিইও’সহ উপস্থিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিগণ জানান যে, পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র/দলিলাদির চেকলিস্ট পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। দাবি নিষ্পত্তিতে বীমাগ্রহীতার অডিট রিপোর্টসহ অতিরিক্ত কাগজ পত্রাদি চাওয়ার বিষয়ে অনেকে আপত্তি জানান। অডিট রিপোর্ট চাইতে হলে সব ক্ষেত্রে চাওয়া উচিত, দু-একটি ক্ষেত্রে নয়।
এ প্রসঙ্গে রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’র সিইও উল্লেখ করেন যে, তাদের পরিশোধিত প্রিমিয়ামের তুলনায় দাবি পরিশোধের চিত্র ভিন্ন। যথা সময়ে লস পেমেন্ট না পেলে কোম্পানিগুলোর টিকে থাকা দুষ্কর। তিনি আরো উল্লেখ করেন রি-ইন্স্যুরেন্স প্রথা অনুযায়ী যে সব কাগজপত্র প্রয়োজন তার বাইরে কাগজপত্র চাওয়া হলে দাবি নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়।
এ প্রসঙ্গে এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স পিএলসি’র সিইও জানান সাবীক দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনেক সময় বীমাগ্রহীতার অডিট রিপোর্ট চায় যার জন্য অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়াও সাবীকের পক্ষ থেকে মনোপলিভাবে টার্মস-কন্ডিশন প্রয়োগ না করে বিজনেস পার্টনার হিসেবে যুক্তিসঙ্গত টার্মস- কন্ডিশন নির্ধারণ করা উচিত।”
“আলোচনায় অংশ নিয়ে বিআইএ সভাপতি উল্লেখ করেন যে, অনেক ক্ষেত্রে ফেব্রিকেটেড ক্লেইমের কারণে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এই আস্থার সংকট নিরসনের জন্য দাবি নিষ্পত্তির যথাযথ চেকলিস্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। তবে চেকলিস্টে যেসব ডকুমেন্টস উল্লেখ রয়েছে তা পুনর্বিবেচনা করে অপ্রয়োজনীয় বা বীমার সাথে সাংঘর্ষিক কাগজপত্রাদি বাদ দেয়া যেতে পারে। দাবি নিষ্পত্তিকরণ প্রক্রিয়া আরো কিভাবে সহজীকরণ করা যায়, তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, বীমার ক্ষেত্রে আমাদের মোরাল হ্যাজার্ড কমানোর বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে।”
সভায় বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিগণ পুনঃবীমা দাবি পরিশোধের ক্ষেত্রে লস পার্টিসিপেশন ক্লজ (এলপিসি) চার্জ না করা অথবা চূড়ান্ত জরিপ রিপোর্টের আলোকে নিরুপিত ক্ষতির অংকের ভিত্তিতে হিসাব করার জন্য অনুরোধ জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে “সাবীকের চেয়ারম্যান বলেন, দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ন্যায্যতার নীতি প্রয়োগ করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। দাবির নথি দ্রুত নিষ্পত্তিতে সার্ভেয়ারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সর্ভেয়ারদের প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। দাবি প্রক্রিয়াকরণে মোরাল হ্যাজার্ড একান্তভাবে কমানো প্রয়োজন। তথাপি দাবি নিষ্পত্তিতে আমরা অত্যন্ত আন্তরিক, প্রয়োজনে সাবীকের পরিচালনা পর্ষদের সাথে আলোচনা করে দাবি প্রক্রিয়াকরণ আরও সহজ ও দ্রুততর করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। দাবি নিষ্পত্তি জন্য প্রস্তাবিত চেকলিস্ট নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পুনঃরায় আলোচনা করা যেতে পারে।”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও নানা অজুহাতে বছরের পর বছর শত শত কোটি টাকার পুনঃবীমা দাবি নিষ্পত্তি না করে ঝুলিয়ে রেখেছে রাষ্ট্রায়ত্ত পুনঃবীমা কোম্পানি সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। ফলে যথা সময়ে গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছে বেসরকারি নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো। ভাঙতে হচ্ছে স্থায়ী আমানত। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যাংক ঋণ নিয়েও গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে হচ্ছে কোনো কোনো কোম্পানিকে। অন্যদিকে যথা সময়ে দাবি না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ায় বীমার প্রতি আস্থা কমছে গ্রাহকদের।
বিপুল পরিমাণ পুনঃবীমা দাবি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে চলতি গত বছরের ২০ মে একটি ত্রিপক্ষীয় সভা করে আইডিআরএ। আইডিআরএ’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় ১০ দফা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার অষ্টম দফায় বলা হয়, কর্পোরেশন ও নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো পুনঃবীমা সংক্রান্ত দেনা পাওনার বকেয়া প্রিমিয়াম ও বকেয়া বীমা দাবির হিসাব ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করবে এবং একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। উল্টো ট্রিটি ক্যান্সেল করার মতো ঘটনা ঘটেছে। সভায় ৯০ দিনের মধ্যে বীমা দাবি নিষ্পত্তি, বীমা আইনের বিধি-বিধানের আলোকে লস এডজাস্টমেন্ট এবং অডিট রিপোর্ট ও ব্যালেন্সশিটের ফিগার দেখে লস এডজাস্টমেন্ট না করার সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কোম্পানি সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পুনঃবীমার প্রিমিয়াম আদায়ে যতটা তৎপর; তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি ‘অনীহা’ বীমা দাবি পরিশোধে। বিদেশি রি-ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যেখানে শুধু সার্ভে রিপোর্ট ও লস ইন্টিমেটেডের ভিত্তিতে পুনঃবীমা দাবির অর্থ পরিশোধ করে দেয়। সেখানে নানা অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়ে দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে টালবাহানা করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন।#
Posted ১০:২০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৮ মার্চ ২০২৫
bankbimaarthonity.com | rina sristy